উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস || Northern Pintails

উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

Northern_Pintails_(Male_&_Female)
উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস (বৈজ্ঞানিক নামAnas acuta), কালদিঘেড়ি বা লেঞ্জাহাঁস Anatidae (অ্যানাটিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Anas (আনুস) গণের অন্তর্ভুক্ত এক প্রজাতির বড় হাঁস।[২][৩] পাখিটি একটি বিশ্বজনীন প্রজাতি; বাংলাদেশভারতছাড়াও পৃথিবীর বহু বিভিন্ন দেশে এদের দেখা যায়। ইউরোপএশিয়া ও উত্তর আমেরিকার উত্তরাঞ্চলে এরা প্রজনন করে। প্রজাতিটি স্বভাবে পরিযায়ী এবং শীতকালে এর প্রজননস্থলের দক্ষিণে বিষুবীয় অঞ্চলের দিকে চলে আসে। সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এরা বিস্তৃত; কেবল দুই আমেরিকাতেই এরা প্রায় ৬৫ লক্ষ ৮০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বসবাস করে। বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এর একাধিক ভৌগোলিক উপপ্রজাতি থাকার কথা। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁসের কোন উপপ্রজাতি নেই। ইটনের ল্যাঞ্জাহাঁসকে একসময় এর সহপ্রজাতিক মনে করা হলেও এরা আসলে ভিন্ন একটি প্রজাতি।
উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস বড় আকারের হাঁস। স্ত্রী-পুরুষ দুই হাঁসেরই নীলচে-ধূসর ঠোঁট এবং ধূসর পা ও পায়ের পাতা থাকে। পুরুষ হাঁস দেখতে চমৎকার, চকলেট রঙা মাথার পেছন থেকে একটি সরু সাদা রেখা ঘাড় হয়ে সাদা দেহতল পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। এছাড়া পিঠ দর্শনীয় ধূসর, বাদামি ও কালো রঙে চিত্রিত থাকে। স্ত্রী হাঁসের দেহে রঙের বৈচিত্র্য কম। দেহ আনুস গণের অন্যান্য স্ত্রী হাঁসের মত মেটে রঙের। স্ত্রী হাঁস প্যাঁক-প্যাঁক করে ডাকে; পুরুষ হাঁসের ডাক বাঁশির শিষের মত।
উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস বিস্তৃত খোলা জলাশয় বা জলাভূমিতে বসবাস করে। সাধারণত পানি থেকে কিছু দূরে মাটিতে বাসা করে। পানিতে ভাসমান উদ্ভিদ এদের প্রধান খাদ্য। তবে প্রজনন মৌসুমে ছোট অমেরুদণ্ডী প্রাণীও খায়। অপ্রজননকালীন সময়ে এরা দলবদ্ধভাবে বসবাস করে, দলে অন্য প্রজাতির হাঁসও ঘুরে বেড়ায়।
শিকারী প্রাণী, পরজীবী ও বিভিন্ন রোগজীবাণুর কারণে এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এছাড়া কৃষিকাজ, শিকার, মৎস্যনিধন প্রভৃতি মনুষ্যসৃষ্ট কারণেও এরা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা কমছে তবে এখনও আশঙ্কাজনক পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছেনি। সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।


বিবরণ


উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস বেশ বড় আকারের হাঁস। এর ডানার দৈর্ঘ্য ২৩.৬–২৮.২ সেমি (৯.৩–১১.১ ইঞ্চি) এবং ডানার বিস্তার ৮০–৯৫ সেমি (৩১–৩৭ ইঞ্চি).[১৩] পুরুষ হাঁসের দৈর্ঘ্য ৫৯–৭৬ সেমি (২৩–৩০ ইঞ্চি) ও ওজন ৪৫০–১৩৬০ গ্রাম (১–৩ পাউন্ড), এবং স্ত্রী হাঁসের তুলনায় যথেষ্ট বড়। স্ত্রী হাঁসের দৈর্ঘ্য ৫১–৬৪ সেমি (২০–২৫ ইঞ্চি) ও ওজন ৪৫৪–১,১৩৫ গ্রাম (১–২.৫ পাউন্ড)।[১৪] আকারে উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস প্রায় নীলশিরের মতো, তবে নীলশিরের তুলনায় এটি খানিকটা লম্বাটে। নীলশিরের তুলনায় এর গলা ও লেজ বেশ খানিকটা লম্বা। প্রজননকালীন পুরুষ হাঁস দেখতে চমৎকার, চকলেট রঙা মাথার পেছন থেকে একটি সরু সাদা রেখা ঘাড় হয়ে সাদা দেহতল পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। পিঠ ও ডানা ধূসর। ডানার নিচ তামাটে। ডানা-ঢাকনি কালো। ডানায় কিছু কালচে অনিয়মিত ডোরা থাকে। অবসারনী অঞ্চল হলদে যা কালো লেজতল-ঢাকনীর বিপরীত।[১১] লেজের লম্বা মধ্য পালকটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ সেমি (৪ ইঞ্চি)।ঠোঁট নীলচে-ধূসর।[১৫]
স্ত্রী হাঁসের মাথা, ঘাড় ও লেজ পুরুষ হাঁসের তুলনায় ছোট ও দেহে রঙের বৈচিত্র্য কম। দেহ আনুস গণের অন্যান্য স্ত্রী হাঁসের মত মেটে রঙের। মাথা ধূসর-বাদামী ও পিঠের বাদামি প্রান্ত ফ্যাকাসে। ঠোঁট চোখা ও ধূসর।[১১] উভয়েরই চোখ ঘন লালচে বাদামি। ঠোঁটের গোড়া কালচে। পা ও পায়ের তল কালচে; পায়ের পর্দা, অস্থিসন্ধি ও নখর কালো। অপ্রজননকালীন পুরুষ হাঁস দেখতে স্ত্রী হাঁসের মত, তবে ঘাড়ে ধূসর পালক বিদ্যমান। অপ্রাপ্তবয়স্ক হাঁসের দেহ স্ত্রী হাঁসের মত, কিন্তু ডানার পালক পুরুষ হাঁসের মত।[৩][১৬]
ল্যাঞ্জাহাঁস মাটিতে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারে, আর সাঁতারে অসম্ভব পটু।[১১] এরা খুব দ্রুত উড়তে পারে। ওড়ার সময় ডানা ঈষৎ পশ্চাৎমুখী থাকে, সম্পূর্ণ মেলে ধরে না। উড়ন্ত অবস্থায় এদের ডানার তলে সাদা প্রান্ত প্রায় ১ মাইল দূর থেকে দেখা যায়।[১৬]
স্ত্রী হাঁস প্যাঁক-প্যাঁক করে ডাকে; পুরুষ হাঁসের ডাক বাঁশির শিষের মত, অনেকটা প্রুপ-প্রুপ

বিস্তৃতি ও আবাসস্থল


উত্তুরে ল্যাঞ্জাহাঁস সমগ্র ইউরেশিয়ার উত্তর থেকে দক্ষিণে পোল্যান্ড ও মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত বিশাল এলাকা জুড়ে প্রজনন করে।[১৪] কানাডাআলাস্কা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলেও এরা প্রজনন করে। শীতকালে এটি দক্ষিণে বিষুব রেখার কাছাকাছি পানামা, উত্তর সাব-সাহারান আফ্রিকা ও ক্রান্তীয় দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত পরিযান করে। অল্প কিছু সংখ্যক হাঁস হাওয়াই ও অন্যান্য প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহে পরিযান করে এবং সেখানকার আবাদি জমি ও অগভীর জলাশয়ে চরে বেড়ায়।[১১]আন্তঃমহাসাগরীয় পরিযানের খবরও জানা গেছে। কানাডার ল্যাব্রাডরে রিং পরানো একটি হাঁস নয় দিন পর ইংল্যান্ডের এক শিকারীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়।

0 comments:

Post a Comment

My Instagram